লীলা মজুমদার
-ইউসুফ মোল্লা
#আজ_সকাল_সকাল_চলে_এসেছি
#লীলা_মজুমদার_নিয়ে
(ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯০৮ - এপ্রিল ৫, ২০০৭)
আমাদের দেশে ‘শতায়ু হও’ বলে আশীর্বাদ করা হয়ে থাকে। বাঙ্গালী লেখক-লেখিকাদের মধ্যে মাত্র দুজন এই একশ বছরের আয়ু স্পর্শ করেছেন বা স্পর্শ করার কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছেছিলেন। তাঁরা হলেন - নীরদ চন্দ্র চৌধুরী এবং লীলা মজুমদার। তবে শত বর্ষের কাছাকাছি আয়ুতে পৌঁছালে অনেক ক্ষেত্রেই সুখের চেয়ে দুঃখ বেদনাই বেশী থাকে। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী প্রায় পুরো সময়টাকেই লেখা পড়ার কাজে লাগিয়েছিলেন। লীলা মজুমদার শেষের প্রায় এক দশক বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। কিন্তু লীলা মজুমদার নিজের কর্মজীবনে এমন কিছু কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তা তাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে। বিশেষতঃ শিশু সাহিত্যে লীলা মজুমদার একটি অপ্রতিদ্বন্দী নাম। এখানে লীলা মজুমদারের পূর্ণাঙ্গ জীবন , তাঁর সাহিত্য কর্মগুলির আলোচনার সাথে সাথে তাঁর রচনা বৈশিষ্ট্য ও বর্তমান প্রজন্মে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।
১৯০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লীলা মজুমদার পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা জেলার বিখ্যাত রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি একজন ভারতীয় বাঙালি লেখিকা। তিনি কলকাতার রায় পরিবারের প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর সন্তান। তাঁর বিবাহের পূর্বে নাম ছিল লীলা রায়। তাঁর জন্ম রায় পরিবারের গড়পাড় রোডের বাড়িতে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (যাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়) ছিলেন প্রমদারঞ্জনের ভাই এবং লীলা মজুমদারের কাকা। সেইসূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।
তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল শিলং-এ। এখানে তিনি ১৯১৯ সাল পর্যন্ত লরেটো কনভেন্টে Loreto Convent তিনি পড়াশোনা করেন। ১৯১৯ সালে তাঁর পিতা কলকাতায় চলে এলে, ইনি সেন্ট জন'স ডাইয়োসেসান স্কুলে ভর্তি হন এবং এখান থেকে ১৯২৪ সালে মেয়েদের ভিতর দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ইনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষায় বিএ অনার্স এবং এমএ পাশ করেন। উল্লেখ্য উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী পরীক্ষায় তিনি ইংরাজীতে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করেন।
১৯৩১ সালে তিনি দার্জিলি-এর মহারাণী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি শান্তিনিকেতন স্কুলে চলে আসেন। এখানে এক বৎসর থাকার পর তিনি কলকাতার অস্টাস কলেজের মহিলা শাখায় যোগ দেন। এখানেও তিনি বেশি থাকেন নি। মাঝে কিছুদিন তিনি অল-ইন্ডিয়া রেডিতে সাত-আট বছর কাজ করেছেন।
১৯৩৩ সালে লীলা মজুমদার বিবাহ করেন দন্ত চিকিৎসক ডাঃ সুধীর কুমার মজুমদারকে। এই বিবাহে তাঁর পিতার প্রবল বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার স্বনির্বাচিত পাত্রকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। পিতৃ পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট থাকলেও পিতার সঙ্গে সম্পর্ক চিরকালের মতো ছিন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে লীলা-সুধীর খুব সুখী দম্পতি ছিলেন। স্বামী আজীবন লীলার সাহিত্য চর্চায় উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের এক পুত্র ডাঃ রঞ্জন মজুমদার ১৯৩৪ সালে এবং এক কন্যা কমলা মজুমদার ১৯৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করে।
মাত্র ১৪-১৫ বছর বয়সে তাঁর প্রথম গল্প 'লক্ষ্মীছাড়া' ১৯২২ সালে 'সন্দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই গল্পের মধ্য দিয়েই তিনি সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন। ১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় 'সন্দেশ' পত্রিকা পনর্জীবিত করলে তিনি ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৪ অবধি সাম্মানিক সহ-সম্পাদক হিসাবে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ১৯৯৪-এ তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য অবসর নেন। তাঁর সাহিত্য জীবন প্রায় আট দশকের।
তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ১৩০-১৫০ -এর মতো। 'সন্দেশ', 'শিশু সাথী', 'মৌচাক', 'খোকাখুকু', 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'শনিবারের চিঠি', 'বিচিত্রা' ইত্যাদি পত্রিকায় ছোটোদের জন্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন লীলা মজুমদার। কৌতুক-কৌতূহল --- আর জীবন অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে লীলা মজুমদারের কথা সাহিত্য। চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার জন্য 'পদি পিসীর বর্মী বাক্স' খুব জনপ্রিয় হয়। 'নাকুগামা'-র নাকু, পাইলট সমরেশ কাকু, ইঞ্জিনিয়ার হামিদ কাকুকে আমরা কখনও ভুলতে পারি না। নানান বেড়ালদের নিয়ে লিখেছেন, 'বেড়ালের বই'। 'কুঁকড়ো' গল্প আমাদের মনুষ্যেতর জীবের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করে। 'শেলটার' গল্পে পাহাড়ের মাথায় সাহেবদের শেলটারের রোমহর্ষক বর্ণনা আমাদের মুগ্ধ করে। চোখ আর মনের সুসম সমন্বয়ে তাঁর গল্প ও উপন্যাস সার্থক হয়ে উঠেছে।
লীলা মজুমদার বলেছেন, 'সাতটা রঙের খেলা নিয়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের হাজার রঙের মেলা বসে। তেমনি মনের জগতেও নয়টা রস দিয়ে দুনিয়ার সাহিত্য ভাণ্ডার ভরা হয়েছে। তারমধ্যে গোটা দুই বাদ দিলে, বাকি সবগুলি দুনিয়ার নয় থেকে নিরানব্বুই সব বয়সিদের জন্য। তার বদলে শুধু চোখ আর মন তার হৃদয়ের দোর খোলা রাখা চাই।'
#গল্পগ্রন্থ:
১) 'বদ্যিনাথের বড়ি' (১৯৪০)
২) 'দিন দুপুরে' (১৯৪৮)
৩) 'ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প' (১৯৫৫)
৪) 'মনিমালা' (১৯৫৬)
৫) 'লাল নীল দেশলাই' (১৯৫৯)
৬) 'বাঘের চোখ' (১৯৫৯)
৭) 'ইষ্টকুটুম' (১৯৫৯)
৮) 'টাকাগাছ' (১৯৬১)
৯) 'ছোটোদের ভালো ভালো গল্প' (১৯৬২)
১০) 'হাস্য ও রহস্যের গল্প' (১৯৭১)
১১) 'বড়পানি' (১৯৭২)
১২) 'হাসির গল্প' (১৯৭৪)
১৩) 'গুণু পণ্ডিতের গুণপনা' (১৯৭৫)
১৪) 'নতুন ছেলে নটবর' (১৯৭৬)
১৫) 'সব সেরা গল্প' (১৯৭৬)
১৬) 'বহুরূপী' (১৯৭৬)
১৭) 'ভূতের গল্প' (১৯৭৮)
১৮) 'কাগ নয়' (১৯৮১)
১৯) 'সেজো মামার চন্দ্র যাত্রা' (১৯৮২)
২০) 'ময়না শাখিল' (১৯৮২)
২১) 'আজগুবি' (১৯৮২)
২২) 'বহুরূপী' (১৯৮২)
২৩) 'বাঁশের ফুল' (১৯৮২)
২৪) 'গুপের গুপ্তধন' (১৯৮২)
২৫) 'ছোটোদের বেতাল বত্রিশ' (১৯৮২)
২৬) 'সব ভুতুড়ে' (১৯৮৩)
২৭) 'গুপী পানুর কীর্তিকলাপ' (১৯৮৩)
২৮) 'কুকুর ও অন্যান্য' (১৯৮৪)
২৯) 'অন্য গল্প' (১৯৮৪)
৩০) 'ছোটোদের শ্রেষ্ঠ গল্প' (১৯৮৪)
৩১) 'শুধু গল্প নয়' (১৯৮৫)
৩২) 'ভুতের বাড়ি' (১৯৮৬)
৩৩) 'ছোটোদের পুরাণের গল্প' (১৯৮৬)
৩৪) 'ছোটোদের দশ দিগন্ত' (১৯৮৮)
৩৫) 'মামাদাদুর ঘোড়াবাজি' (১৯৮৯)
৩৬) 'ত্রিমুকুট' (১৯৯০)
৩৭) 'আগুনি বেগুনি'
৩৮) 'আম গো আম' (১৯৯১)
৩৯) 'টিপুর উপর টিপ্পুনি' (১৯৯১)
৪০) 'জানোয়ার গল্প' (১৯৯১)
৪১) 'পটকা চোর' (১৯৯১)
৪২) 'কুশলদার কৌশল' (১৯৯২)
৪৩) 'বেড়ালের বই' (১৯৯২)
৪৪) 'গোলু' (১৯৯২)
৪৫) 'লীলা মজুমদারের শ্রেষ্ঠ হাসির গল্প' (১৯৯২)
৪৬) 'আষাড়ে গল্প' (১৯৯৩)
৪৭) 'মহাভারতের গল্প' (১৯৯৪)
৪৮) 'চিচিং ফাঁক' (১৯৯৪)
৪৯) 'কল্পবিজ্ঞানের গল্প'
৫০) 'আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ'
৫১) 'নেপোর বই'
৫২) 'নোটোর দল'
৫৩) 'ফুলমালা'
৫৪) 'মিঠুর ডেয়ারি'
৫৫) 'বাঘ শিকারী বামুন'
৫৬) 'বাঘিয়ার গল্প'
৫৭) 'মণি মানিক' (২০০০)
৫৮) 'চিরদিনের গল্প' (২০০০)
৫৯) 'হীরে মোতি পান্না' [অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে একত্রে] (১৯৭৮)
৬০) 'টাকা গাছ' [জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে] (১৯৬১)
৬১) 'হট্টমালার দেশে' [প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে যুগ্মভাবে] (১৯৭৭)
#উপন্যাস :
১) 'পদিপিসীর বর্মী বাক্স' (১৯৫৩)
২) 'হলদে পাখির পালক' (১৯৫৭)
৩) 'জোনাকী' (১৯৫৮)
৪) 'শ্রীমতী' (১৯৫৮)
৫) 'ঝাঁপতাল' (১৯৫৮)
৬) 'গুপির গুপ্ত কথা' (১৯৫৯)
৭) 'বক ধার্মিক' (১৯৬০)
৮) 'চীনে লণ্ঠন' (১৯৬৩)
৯) 'মাকু' (১৯৬৯)
১০) 'নেপোর বই' (১৯৬৯)
১১) 'ফেরারী' (১৯৭১)
১২) 'নাকুগামা' (১৯৭৩)
১৩) 'বাতাস বাড়ি' (১৯৭৪)
১৪) 'দুলিয়া' (১৯৭৭)
১৫) 'টংলিং' (১৯৮১)
১৬) 'হাওয়ার দাঁড়ি' (১৯৮৩)
১৭) 'চকমকি মন' (১৯৯০)
১৮) 'মণিকাঞ্চন' (১৯৯৩)
#প্রবন্ধ_নিবন্ধ :
১) 'হাতি হাতি' (১৯৫৭)
২) 'রান্নার বই' (১৯৭৯)
৩) 'ভুতোর ডাইরি' (১৯৭৯)
৪) 'জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি' (১৯৮৬)
৫) 'পাকদণ্ডী' (১৯৮৬)
৬) 'ঘরকন্নার বই' (১৯৮৮)
৭) 'আমি নারী' (১৯৮৯)
৮) 'আমিও তাই' (১৯৮৯)
৯) 'সংসারের খুঁটিনাটি ও শিশুদের নামকরণ' (১৯৯০)
১০) 'যে যাই বলুক' (১৯৯২)
১১) 'হালকা খাবার' (১৯৯৩)
১২) 'আনন্দ ঝর্ণা' (১৯৯৭)
১৩) 'রহস্য ভেদী পাঁচ'
১৪) 'নাটঘর'
১৫) 'ভারতের লোককথা'
১৬) 'মধুকুঠির মারকুটে মৌমাছি'
১৭) 'ঠাকুমার ঠিকুজি'
১৮) 'দেশ বিদেশের বিচিত্র উপকথা'
১৯) 'ভারতের উপকথা' (১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ খণ্ড)
#নাটক :
১) 'বক বধ পালা' (১৯৫৯)
২) 'গাওনা' (১৯৬০)
৩) 'মোহিনী' (১৯৬৩)
৪) 'লঙ্কা দহন পালা' (১৯৬৪)
৫) 'লীলা মজুমদারের ছোটোদের নাটক সমগ্র'
#জীবনী_মূলক_গ্রন্থ :
১) 'এই যা দেখ' (১৯৬১)
২) 'কবি কথা' (১৯৬১)
৩) 'উপেন্দ্রকিশোর' (১৯৬৩)
৪) 'অবনীন্দ্রনাথ' (১৯৬৬)
৫) 'সুকুমার' (১৯৮৯)
৬) 'মহামানব চরিত'
#স্মৃতিচারণা_মূলক_গ্রন্থ :
১) 'আর কোনোখানে' (১৯৬৭)
২) 'খেরোর খাতা' (১৯৮২)
#আত্মজীবনী_মূলক_গ্রন্থ :
১) 'পাকদণ্ডী' (১৯৮৬)
#রচনা_সংগ্রহ :
১) 'ছোটোদের অমনিবাস' (১৯৬৫)
২) 'লীলা মজুমদারের রচনাবলী' (৬ খণ্ড, ১৯৭৬-১৯৮৬)
৩) 'লীলা অমনিবাস' (১ম - ১৯৮৫, ২য় - ১৯৮৫)
৪) 'চিরকালের সেরা' (১৯৯৭)
৫) 'রায় পরিবারের চার পুরুষের লেখা'
৬) 'ঠাকুরমার ঝুলি' (২০০৪)
#অনুবাদ_গ্রন্থ :
১) 'নদী কথা' [মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে]
২) 'ভারতে বিদেশী যাত্রা'(১৯৭১)
৩) 'চার বিচারকের দরবার'(১৯৭৪)
৪) 'বাঘদাঁত'(১৯৭৫)
৫) 'অ্যাণ্ডারসন রচনাবলী'(১৯৭৬)
৬) 'গালিভারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত'(১৯৮৩)
৭) 'সরস গল্প'
#উল্লেখযোগ্য_চলচ্চিত্রায়িত_বই :
১) 'পদিপীসির বর্মী বাক্স' (১৯৫৩) উপন্যাস। এর অনেক সংলাপের মধ্যে একটি সংলাপ সবার মুখস্ত বলা যায়। ‘চুপ! চোখ ইজ জ্বল জ্বলিং’। সত্যজিৎ রায় এই উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কোনো কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাই অন্য চলচ্চিত্রকার এই উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন।
#সম্পাদিত_পত্রিকা :
১) 'সন্দেশ' [সত্যজিতের রায়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে]।
মৃত্যু :২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল তিনি কলকাতার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
#তথ্য_বিশ্লেষণ :
উপরোক্ত আলোচনায় যে সকল তথ্য পাওয়া গেল তা নিচে বিশ্লেষণ করা হলো।
( i ) 'পাকদণ্ডী' (১৯৮৬) নামে তাঁর লেখা আত্মজীবনীতে তাঁর শিলঙে ছেলেবেলা, শান্তিনিকেতন ও অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গে তাঁর কাজকর্ম, রায়চৌধুরী পরিবারের নানা মজার ঘটনাবলী ও বাংলা সাহিত্যের মালঞ্চে তাঁর দীর্ঘ পরিভ্রমণের কথা বর্ণিত হয়েছে।
( ii ) একবার এক বৈঠকী আড্ডায় লীলা মজুমদারের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ছোট্ট একটা ঘটনার অবতারনা করেছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি কোনো একটা উৎসব উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। দুটি অপরিচিত ছেলেমেয়ে এসে বললো, লীলা মজুমদার একবার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। শুনে তিনি বেশ অবাক। লীলা মজুমদার কেন ডাকবেন আমাকে? সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তখন তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। সত্যজিৎ রায়ের চিঠি নিয়ে মাঝে মধ্যে সে পত্রিকায় দু’একবার লিখেছেন - 'কোনো লেখায় কি কিছু ভুল হয়েছে?' শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে একটা চেয়ারে তিনি বসেছিলেন। তাঁর লেখায় যত মজা ও রঙ্গরস থাকে মুখের ভাবে কিন্তু তার কিছুই নেই। বরং একটু কঠোর ভাব, ভ্রু কোঁচকানো। তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার পর তিনি বললেন, 'শোন, তুমি গল্প উপন্যাস কবিতা লেখো টেখো, তা আমি কিছুই পড়িনি। তবে তুমি ছোটদের জন্য কিছু লেখালেখি করছে দেখে খুশী হয়েছি। সব লেখকদেরই শিশু সাহিত্যের সেবার জন্য খানিকটা সময় দেওয়া উচিৎ। আর শোন, এইসব লেখার মধ্যে যেন খুনোখুনি, রক্তারক্তি বেশী এনোনা।' অবশ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সারাজীবন উনার নির্দেশ মেনে চলার চেষ্টা করেছেন। শুধুমাত্র একশ ছোয়া বাঙ্গালী নয়, লীলাদেবীর জীবন পটে শতবর্ষের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। ১৯০৮ থেকে ২০০৭ - এই সেঞ্চুরী জানাবে, এই কালপর্বে জড়িয়ে আছে দুটি শতাব্দী। বিশ এবং একুশ। কিন্তু বাঙ্গালীর জীবনবৃত্তান্ত যারা জানেন, তারা বুঝবেন এই সময়টুকুর ভিতরে কী বিপুল পাল্টেছে বাংলা ও বাঙ্গালী। লীলা মজুমদারের শতক জোড়া জীবন যেন এক আয়না। সেই দর্পনে সময়ের বিবর্তন, কিংবা সময়ের পাল্টে যাওয়ার ছবি ভেসে উঠেছে। আয়নাটি ছোট, কিন্তু তার মধ্যেই জেগে আছে একশ বছরের উত্থান পতন। সেই একশ বছরের মধ্যে বাঙ্গালীর ঘরকন্না আছে। বাঙ্গালীর বিশ্বরূপ দর্শণও আছে। যে বাঙ্গালী ঘর এবং বাহির, দেশ আর বিদেশকে মিলিয়েছিল নিজস্ব শিক্ষায়, গত একশ বছর ধরে সেই বৃহৎ বাঙ্গালীরই প্রতিমূর্তি লীলা মজুমদার। কোন অন্তিম সংস্কারেই একশ বছরের দীর্ঘ সৃষ্টিশীলতা ফুরায়না। শতায়ুর আলো এক সময় নিভে যায়, কিন্তু একশ বছরের একটি মৃত্যু মাইলফলকের মতো জেগে থাকে জনজীবনে। সুতরাং, একশ বছর ছুঁয়ে একটি যাত্রা শেষ করলেন লীলা মজুমদার। সেই সঙ্গে থেকে গেল বেশ কিছু অসামান্য বই। একটি একশ বছরের উত্তরাধিকার।
( iii ) সবার মঝে মূলত শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই খ্যাতি, কিন্তু সারা জীবনই মেনেছেন সি. এস. লুইসের কথা - ‘এ গুড চিলড্রেনস বুক ইজ দ্যাট হুইচ এ্যান এডাল্ট ক্যান এনজয়।’ কালি কলম এবং পরিনত একটা মন নিয়ে ছোটদের মনোরাজ্যে ডুব দিয়েছিলেন।
( iv ) লীলা মজুমদারের গল্পে প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক চিত্র স্পষ্ট রূপে ফুটে ওঠে। যেমন তাঁর বকধার্মিক গল্পে বলা হয়েছে '' ছোটবেলায় পাহাড়ের দেশে থাকতুম। সেখানে বাড়ির পেছনে ঢালুর নিচে নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে ছলছল করে পাহাড়ি নদী বয়ে যেত। সরল গাছের বনের মধ্যে দিয়ে হু হু করে হাওয়া বইতো। রাতে নদীর ধারে ধারে ঝোপে ঝোপে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলতো। ''
( v ) লীলা মজুমদারের গল্প ও উপন্যাসগুলির মধ্যে ভাষার সহজ সরল অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তিনি অহেতুক জটিল ভাষার প্রয়োগ করে তাঁর লেখাকে ভারাক্রান্ত করতে চান নি।
( vi ) লীলা মজুমদারের সর্বাধিক জনপ্রিয় সাহিত্য কীর্তিগুলির মধ্যে '' পদী পিসির বর্মী বাক্স '' সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
( vii ) তিনি ভুতের গল্প লেখাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং তাঁর রচিত ভূতেরা ততটা ভয়ঙ্কর ছিল না। এ ক্ষেত্রে তাঁর রচিত '' পেনেটিতে '' গল্পটি উল্লেখ করা যেতে পারে। এই গল্পে শিশু - কিশোর মনের স্বাভাবিক চাহিদা , সমস্যার সমাধান - ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সহজ ভাষায় , কিছুটা মজার ছলে এবং বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে উপস্থাপন করেছেন। গল্পটিতে বন্ধুত্ব ও বন্ধুত্বের বিভিন্ন টানাপোড়েন সুন্দরভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে।
( viii ) ভূতের গল্প লেখার অপর একটি ধারাও সমানভাবে জনপ্রিয়। এক্ষেত্রে প্রথমদিকে গল্পটিকে অলৌকিক ভূতের গল্প মনে হলেও ঘটনার পরিণতিতে দেখা যায় সেখানে ভূতের পরিবর্তে অলৌকিকতার অন্য কোনো মনুষ্যসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক কারণ রয়েছে। এই ধরণের গল্প লেখার ক্ষেত্রেও লীলা মজুমদার মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো - '' হানাবাড়ি '' । এই গল্পে দেখা যায় বাজি জেতার জন্য একজন ব্যাক্তিকে ভূত সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
( ix ) লীলা মজুমদারের গল্পে মানবত্ব ; মানুষ ও প্রাণীর স্বাভাবিক বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক - এই বিষয়গুলিরও প্রকাশ ঘটেছে। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো '' দুই মা '' নামক গল্পটি। গল্পটিতে মানুষ ও হাতির সুমধুর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পের এক জায়গায় লেখিকা বলেছেন - '' সেকালে হাতির দেশ ছিল ওটা। মানুষে - হাতিতে মিলেমিশে বেশ ছিল। ''
( x ) সেকালের গ্রামবাংলার কিছু অংশের মানুষ বাঘের ভয়ে কতটা ভীত ছিলেন এবং হিংস্র প্রাণীদের বিরুদ্ধে তাদের কতটা সংগ্রাম করতে হতো তারও উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁর লেখাতে। যেমন '' দুই মা '' গল্পে লেখা আছে - '' সেই ফাঁকে একটা কালো বাঘ এসে প্রধানের পাঁচ মাসের ছেলেকে গায়ে জড়ানো কাঁথা শুদ্ধ তুলে নিয়ে দে ছুট।.............চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে প্রধানের বউ বাঘের পেছনে ছুটলো। ''
( xi ) সাধারণতঃ বাংলা সাহিত্যে নিজের গল্পের নিজেই নাট্যরূপ নির্মাণ করেছেন - এমনটা দেখা যায় না। কিন্তু লীলা মজুমদার এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম। তিনি তাঁর রচিত '' আঁধারমণি'' গল্পের নাট্যরূপ প্রদান করেছেন এবং সেই নাটকের নাম দিয়েছেন '' আলো '' ।
( xii ) লীলা মজুমদারের রচনাতে বিভিন্ন ছোট ছোট ছড়ার উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। যেমন '' আলো '' নাটকে রচিত তাঁর একটি ছড়া হলো -
হুতুমরা :
হুতুম থুম হুতুম থুম
কে যায় রেতে ?
চোখে নেই ঘুম ?
বাঁকা ঠোঁট , ভাঁটা চোখ ,
জোরালো পাখা , ধারালো নোখ।
লক্ষ্মী পেঁচারা :
আমরা প্যাঁচা ,প্যাঁচা ,প্যাঁচা,
এবার প্রাণের ভয়ে চ্যাঁচা !
পাসনি ভয় -
তাই কি হয় ?
হুতুম থুম হুতুম থুম।
( xiii ) লীলা মজুমদারের গল্পের মধ্যে মহাকাশ সম্পর্কে আলোচনাও পাওয়া যায় এবং এই আলোচনা শিশু ও কিশোর মনকে কল্পনার ডানা মেলে উড়ে যেতে সহায়তা করে। যেমন তাঁর রচিত '' নেপোর বই '' গল্পটিতে চাঁদ সম্পর্কে ও চাঁদে অবস্থানের সম্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
( xiv ) পুরস্কার ও সম্মাননা :-
১) 'আর কোনোখানে' (১৯৬৭) স্মৃতিচারণা মূলক গ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে 'রবীন্দ্র পুরস্কার' পেয়েছেন।
২) 'বক বধ পালা' (১৯৫৯) নাটকের জন্য তিনি 'সঙ্গীত নাটক একাডমী পুরস্কার' পেয়েছেন।
৩) 'হলদে পাখির পালক' (১৯৫৭) উপন্যাসের জন্য তিনি 'স্টেট পুরস্কার' ও 'শিশু সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করেন।
#তথ্য_সংগ্রহ:
১.সুকুমার সেন
২.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩.বিভিন্ন ব্লগ
৪.ওয়েব সাইটের বিভিন্ন পেজ
৫. উইকিপিডিয়া
উপকৃত হলাম @ইউসুফ মোল্লা
ReplyDelete'সব ভূতুড়ে' গল্পগ্রন্থের মধ্যে দিয়ে প্রাপ্ত লেখক লীলা মজুমদারের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলিকে উদাহরণসহ বিশ্লেষণ করো।
ReplyDelete