জীবনানন্দ দাশ: প্রতিবন্ধকতা ও সফলতা
- ইউসুফ মোল্লা
"সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি"(কবিতার কথা) - এই কথা যিনি বলতে পারেন, তিনি যে 'শুদ্ধতম কবি' হবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেন না। জীবনের আনন্দ নিয়ে জীবনানন্দ হননি, জীবদ্দশায় তিনি পাঠকমহলে জনপ্রিয় ছিলেন না। তাইতো মাত্র সাতটি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল জীবদ্দশায়। মৃত্যুর পরে তাঁর লেখার খাতায় অগ্রন্থিত প্রচুর কবিতা, গল্প পাওয়া যায়। সত্তর দশকের পরে পাওয়া উপন্যাসগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরে জানতে পারা যায়, তিনি শুধু কবি নন, মনোগ্রাহী উপন্যাসিকও। যেমন- মাল্যবান (১৯৭৩),সুতীর্থ(১৯৭৭), সফলতা-নিষ্ফলতা(২০০৫)। একইভাবে প্রবন্ধকার হিসাবে পরিচিতি লাভ না ঘটলেও তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বই 'কবিতার কথা'(১৯৫৬) বাংলা সাহিত্যের রদবদল ঘটিয়ে দেয়। তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশ যে ধরনের 'আদর্শ ছেলে' খুঁজেছেন, তিনি তা হয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কথায় বড় হননি, কাজের মাধ্যমেই বড় হয়েছেন।
কবি ছিলেন অসম্ভব গম্ভীর প্রকৃতির এবং চরম ধৈর্যশীল মানুষ। ভালোবাসতেন পরিবারকে, সংসারের টুকিটাকি কাজগুলো ভালোবাসতেন। দুই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী লাবণ্যের পেনসিলের মাথা ধার করা, ফাউন্টেন কলমে কালি ভরার কাজগুলো নিয়ে কখনো ভাবতে হতো না। এমনকি ছেলেমেয়েকে রাত জেগে ঘুম পাড়ানোতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ভালোবাসতেন গুরুত্ব পেতে, সামান্য অসুখে আশা করতেন সেবা–শুশ্রূষা পেতে। তাঁর রাশভারী স্বভাবেও মাঝেমধ্যে কৌতুক করতেন। আর খেতে ভালোবাসতেন ডিম। ডিমের যেকোনো পদ দেখলেই তিনি লোভ সামলাতে পারতেন না। ছেলের পাতের থেকে ডিমের কিছু অংশ খাওয়া নিয়ে বাপ–ছেলের খুনসুটি প্রায়ই লেগে থাকত।
একটা ঘটনা উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে শুধু পাঠক নয়, সম্পাদকরাও জীবনানন্দের লেখাকে পছন্দ করতেন না। 'ক্যাম্পে' কবিতাটি জীবনানান্দিক বিপন্নতা নিয়ে লেখেন কবি। কিন্তু পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক ছাপতে নারাজ। তখন পত্রিকার সম্পাদনায় ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সুধীন দত্ত জীবনানন্দের লেখার আঙ্গিক তথা উপমার বাহুল্য এবং বিন্যাসের আঁটোসাঁটো বোধের অভাবের কারণে তাঁর লেখার গুণগ্রাহী ছিলেন না। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁকে কবি বলেও গণ্য করতেন না। তথাপি কবি বিষ্ণু দে’র চাপে বাধ্য হয়ে কবিতাটি পরিচয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। কেননা বিষ্ণু দে কবিতাটি জীবনবাবুর কাছ থেকে নিজে চেয়ে এনেছিলেন। প্রকাশের পরপরই কবিতাটি সমকালীন সমালোচক ও কবিসমাজের কাছে, জীবনানন্দের আরও কিছু মেটাফোরের নতুনত্বে সমুজ্জ্বল কবিতার মতোই অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য বলে পরিগণিত হয়েছে। কবিতাটি নিয়ে রূঢ় সমালোচনার মুখে পড়েন কবি। ধারণা করে নেয়া যায়, এর বেশির ভাগই কবিতার পাঠে কবিতাটি অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য ঠেকার কারণেই। কবিতাটি নিবিড় পাঠে দেখা যাবে, কবিতাটি শুরু হয়েছে যদিও বনে মৃগয়া গমনের পরে ক্যাম্প ফেলবার কথা থেকে, তথাপি ক্যাম্পে যাওয়া এবং শিকার এই কবিতার মূল বিষয় নয়।
ভীষণ অন্তর্মুখী এবং নিজের গণ্ডির ভেতরে চিরকাল বসবাস করা জীবনানন্দ দাশ অদ্যাবধি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে কখনো শিকারে যান নি। এছাড়া শিকারির শিকার প্রসঙ্গে আরেকটি কবিতায় তার অসমর্থন প্রকাশ পেয়েছে [হরিণ কবিতাটিতে]। এই কবিতাটিতে একটি অসমীয়া শব্দ ঘাই ব্যবহৃত হয়েছে [টোপ অর্থে]। শব্দটি যদি আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে তিনি আসাম গিয়েছেন বা অসমীয়া ভাষী কারো সাথে মিশে থাকবেন, তবে বলতে হয় তিনি কখনোই আসাম যান নি। জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দের বিবৃতি হতে জানা যায়, তিনি মুনিরুদ্দি নামে একজনের সাথে কথা বলতেন প্রায়ই, যে ছিল কিনা একজন শিকারি। তার কাছে জীবনানন্দ দাশ শিকার সম্বন্ধীয় অনেক কিছুই শুনতেন। ধরে নেয়া যেতে পারে এই লোকটির কাছ থেকেই তিনি অসমীয়া এ শব্দটি শুনেছেন।
যাই হোক ‘ক্যাম্পে’ কবিতার প্রতিবেশ এবং চরিত্র চিত্রণে কবি যেন সুনিপুণ নাট্যকারের ভূমিকা নিয়েছেন। কবিতাটির মূল সুর আদৌ যে ক্যাম্প বা হরিণ শিকার নয় সেই বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি কবিতার মধ্যভাগে। কবিতার সুরে ক্যাম্পে অবস্থানরত কথক [ধরে নেই ভ্রমণ উদ্দেশ্যে আগত, যেহেতু উল্লেখ নেই আগমনের কারণ] শুনতে পাচ্ছেন এক ঘাই হরিণীর ডাক
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি—
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন
এই ঘাই হরিণী ডাকছে। কে কাকে ডাকছে ? প্রকৃতপক্ষে এই ঘাই হরিণীটি কি? এটা সবার জানা, ঘাই হরিণী বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে জ্যান্ত হরিণ, যাকে টোপ হিশাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রখ্যাত জীবনানন্দ গবেষক ক্লিনটন বি সিলি A Poet Apart বইয়ে উল্লেখ করেন, এই ঘাই হরিণীর ব্যবহার জীবনানন্দের জীবনের এক অসফল অধ্যায়ের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে প্রেমিকা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে অবজ্ঞা ভরে। এ ব্যাপারে জীবনানন্দের আত্মীয় পরিজনদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, তার জীবনে কোনো রমণীর সাথে এমন কোনো সম্পর্ক ছিল বিয়ের আগে কিংবা পরে। এই বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা না পাওয়া গেলেও আমরা ধরে নিতে পারি শিকারের অর্ন্তদ্বন্দ্বমূলক একটা প্রতিবেশ তৈরির জন্য তিনি শিকারি, শিকার ও প্রলোভনের এক জটিল ফাঁদ পেতেছেন।
বাস্তবিক অর্থে কবিতার সমালোচনা করতে এসে সজনীকান্ত সকল ভব্যতা ও সাহিত্যিক শ্লীলতাকে অতিক্রম করে ইতর শ্রেণির আক্ষরিক পাঠ দ্বারা কবিতাটির সমালোচনা করেন। আরেক অংশে সজনী ‘পরিচয়’-এর মতো উচ্চশ্রেণির পত্রিকা, যাতে রবীন্দ্রনাথ, হীরেন্দ্রনাথের লেখা ছাপা হয় সেখানে এরূপ অশ্লীল কবিতা কিরূপে ছাপা হয় এই প্রশ্ন তোলেন। ক্যাম্পে কবিতাটি তার মতে, পরিচয়ের অশ্লীলতা চর্চার চূড়ান্ত নমুনা।
প্রকৃতপক্ষে সজনীকান্তের মতো দ্বিতীয়শ্রেণির নেতিবাচক সমালোচকের দ্বারা বাংলা কাব্য ধারার বাঁকবদলকারী এমন একটি কবিতার এমন রূঢ় সমালোচনা হবে এটা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়। এ কবিতায় এমনকি সুন্দরী গাছের কথাকে উল্লেখ করে কবিকে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেন, কবির তন্ময়তায় না হয় গাছও সুন্দরী হইল! (তিনি সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের কথা জানতেন না)। এছাড়াও নিজের পত্রিকায় জীবনানন্দের নাম বিকৃত করে ছাপতেন, লিখতেন জীবানন্দ। জীবনানন্দকে কবি গণ্ডার বলে ডাকতেন। এছাড়াও তাকে বর্ণবাদমূলক বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে প্রায়ই। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের লেখক কবিদের লেখাকে তিনি তাচ্ছিল্য করতেন পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য বলে। তিনি ব্যঙ্গ করে লেখেন,
“এই সাহিত্যের স্পেন্সার হইতেছেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস, ব্রাউন-কালীপ্রসন্ন ঘোষ, বিদ্যাসাগর এবং হুইটম্যান—শ্রী জীবানন্দ দাশগুপ্ত (লক্ষণীয় কবির নাম বিকৃতি); ইহার ম্যাথু আর্নল্ড ও ওয়াল্টার পেটার যথাক্রমে শ্রীমান বুদ্ধদেব বসু ও শ্রীমান অজিতকুমার দত্ত।”
যে রবিঠাকুর বুদ্ধদের বসুর কাছে লিখিত পত্রে জীবনানন্দের কবিতাকে চিত্ররূপময় বলে উল্লেখ করেছেন সেই কবিগুরুর কাছেও অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল ‘ক্যাম্পে’। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সুধীন দত্তের কাছে বলেন, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় কোনো স্টাইল নেই, আছে পাঁচমিশালী ভাব। প্রকৃতপক্ষে বাংলা কাব্যজগতে রবীন্দ্রনাথের সমকালীন আর কোনো কবি লেখকই তাদের আঙ্গিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেক রবীন্দ্রনাথের থেকে এত বেশি পৃথক ছিলেন না। সেই ক্ষেত্রে চিরকালীন রোম্যান্টিসিজম ও আধ্যাত্মবাদের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনানন্দ দাশের মানবের চিরন্তন বিপন্নতা এবং না পাওয়ার বোধে ন্যুব্জ স্যুরিয়ালিস্টিক কবিতাটি ভালো না লাগাটাই ছিল স্বাভাবিক।
বিরূপ সমালোচনায় অতিষ্ঠ হয়ে জীবনানন্দ প্রথম বারের মতো তার কবিতার সমালোচনা বিষয়ে কলম ধরলেন। যদিও এই প্রতিক্রিয়াটি জীবনানন্দের স্বভাব সুলভ আচরণের কারণেই প্রকাশ পায় নি তার জীবদ্দশায়। পরবর্তীতে জীবনানন্দ অনুগ্রাহী কবি ভূমেন্দ্র গুহর কাছে লেখাটি ছিল। তিনি সেটি ‘শতভিষা’ পত্রিকার ভাদ্র ১৩৮১ সংখ্যায় প্রকাশ করেন।
নিজেকে সবসময় আড়াল রাখতে ভালোবাসতেন কবি। তাঁর এই প্রচারবিমুখতার জন্য বুদ্ধদেব বসু তাঁকে 'নির্জনতম কবি', অনেক জায়গায় 'আমাদের নির্জনতম কবি' বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
রবীন্দ্রযুগের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও রবীন্দ্র প্রভাবকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। কোন বিধি-নিয়ম এবং যুক্তি না মেনে অবচেতন মনকে শিল্প সাহিত্যে রূপান্তরিত করার ফলে কবিতায় পাঠকের হৃদয়ে এক নতুন চেতনার সৃষ্টি করেন 'পরাবাস্তববাদী কবি' জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মানব বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড, রুশ বিপ্লব, সামন্তবাদী আন্দোলনের প্রসার, আশা- নিরাশার দোলাচল, নৈরাশ্য, ব্যর্থতা, বেদনাসহ জীবনের এক জটিল সময় বাংলা কাব্যাঙ্গনে জীবনানন্দের লেখনীতে ফুটে ওঠে। জীবনকে রূপায়িত করতে প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ডুব দিয়েছিলেন তিনি। কবি চৈতন্যমগ্ন হয়েও সারাজীবন সত্যকে সন্ধান করেছেন।
কবির জন্ম যেহেতু বাংলাদেশের বরিশালে, তাই বর্তমানে একটা দাবী জোরালো হচ্ছে- বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে জীবনানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক। একসময় যে কবি মিলু ছিলেন, পরে তিনি শ্রী, আরো পরে শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, তিনিই আবার জীবনানন্দ দাশ। আর এখন তিনি একজন ব্যক্তি নয়, একটা প্রতিষ্ঠান।
কবির লেখাগুলো যে উৎকৃষ্ট হচ্ছে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তাঁর প্রথম দিকের লেখাগুলো থেকেই। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ দাশ তাঁর স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তাঁর প্রথম কাব্যসংকলন 'ঝরাপালক'(১৯২৭) -এ স্থান করে নেয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, "এ কবিতাটি নিশ্চয়ই কোন প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা"। তবুও তাঁর কবিতা কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়। যার ফলস্বরূপ তিনি সিটি কলেজের চাকরিটি হারান। পরে যদিও মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বাগেরহাট প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এইসময় কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছিলেন। তারপর ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলে আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পান। তারপর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে লাবণ্য দেবীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর আর দিল্লিতে ফিরে যাননি তিনি। ফলে সেখানকার চাকরিটি খোয়ান। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় কবি কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। এরপর নানা কর্মসংস্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৩৫ সালে তাঁর পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন কলেজে ফিরে যান। সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন মিলে একটি পত্রিকা বের করেন, যার নাম 'কবিতা'। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের একটি কবিতা স্থান করে নেয়, যার নাম ছিল 'মৃত্যুর আগে'। কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেবকে লেখা একটি চিঠিতে মন্তব্য করেন কবিতাটি 'চিত্ররূপময়'। 'কবিতা' পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতেই তাঁর কিংবদন্তিতুল্য 'বনলতা সেন' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন, যার নাম ছিল 'বাংলা কাব্য পরিচয়' এবং এতে জীবনানন্দ দাশের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি স্থান পায়। ১৯৩৯ সালে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়। এতে জীবনানন্দের চারটি কবিতা- পাখিরা, শকুন, বনলতা সেন এবং নগ্ন নির্জন হাত অন্তর্ভুক্ত হয়। এতকিছুর পরও কবিকে তাঁর প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ নিজের টাকায় প্রকাশ করতে হয়েছিল।
জীবনানন্দ দাশ সবসময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কলকাতায় যখন ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল, তখন তিনি লেখেন '১৯৪৬-৪৭' কবিতাটি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জনপ্রিয় কবিতার বই 'বনলতা সেন' সিগনেট প্রেস কর্তৃক পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকানুকূল্য লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন কর্তৃক ঘোষিত "রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার" জয় করে। ১৯৫৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা । বইটি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা দূর করেছিলেন।
জীবদ্দশায় তাঁর একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পয়ষটিরও বেশি খাতায় “লিটেরেরী নোটস” লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও প্রকাশিত হয়নি।
জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ।তাই মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বাংলা কবিতায় নতুন বাঁক সৃষ্টি করে জীবনানন্দ দাশের বিরল উত্থান এবং তার নিরঙ্কুশ স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও তার মাপের একজন কবির একখানা জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হতে মরণোত্তর ১৭ বছর লেগে গিয়েছিল। ‘জীবনানন্দ’ নামে গোপালচন্দ্র রায়ের এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। এর দীর্ঘ ১৯ বছর বিরতির পর জীবনানন্দের জীবনীভিত্তিক আরও একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। এটি নিছক জীবনীগ্রন্থই ছিল না, এমনকি রচিতও হয়নি বাংলা ভাষায়। বস্তুত, কবির জীবন ও সাহিত্য উভয় বিষয় নিয়ে গবেষণাঋদ্ধ এ রকম একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ বাংলা ভাষায় আগে একটিও ছিল না। ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ নামের এই সমৃদ্ধ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ইংরেজি ভাষায় সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই দুরূহ এবং পরম কাঙ্ক্ষিত কাজটি করেছিলেন মার্কিন গবেষক ও অধ্যাপক ক্লিন্টন বুথ সিলি। তার এ বইটি প্রকাশের আরও ২০ বছর পর এটির প্রথম বাংলা অনুবাদ করার সৌভাগ্য হয় এই লেখকের, যেটি ‘অনন্য জীবনানন্দ’ নামে প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। কলকাতা থেকে বইটির একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি ফলবতী হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য ১৯৯৯ সালে মূল ইংরেজি বইটির একটি ছায়ালিপি সংস্করণ প্রকাশ করেছিল।
তার এই গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছুটা জানা আছে এমন অনেকেরই ধারণা যে, ক্লিন্টন সিলি ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকান পিস কর্পস-এর সদস্য হিসেবে বরিশাল জিলা স্কুলে যখন বিজ্ঞান শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তখনই জীবনানন্দ দাশের রচনার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে ক্লিন্টন সিলির প্রথম পরিচয় হলেও জীবনানন্দ সম্পর্কে তিনি জানতে পারেন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর। মূলত সিলির বরিশাল পর্বের এক দশক আগেই কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন জীবনানন্দ। এমনকি জীবনানন্দের বিস্তৃত কর্মের সঙ্গেও বরিশালসূত্রে তার কোনো পরিচয় ঘটেনি। দেশে ফেরার পর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর এবং আইওয়াতে রাইটার্স ওয়ার্কশপের সতীর্থ কবি জ্যোতির্ময় দত্ত (বুদ্ধদেব বসুর জামাতা) সিলিকে প্রথম জীবনানন্দের শব্দ এবং রূপকল্পের বিস্ময়কর ভুবনের সঙ্গে পরিচিত করান। অঙ্কুর সাহাকে ২০০৬ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (শারদীয় ‘কবিসম্মেলন’ পত্রিকায় প্রকাশিত) ক্লিন্টন জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়ের কথা বলেন এভাবে, ‘জ্যোতি আমাকে জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিলেন। কোন কবিতাটি আমরা প্রথম পড়েছিলাম, আমি মনে করতে পারছি না। বোধ হয় ‘আট বছর আগের একদিন’, যেটিতে ছিল তাড়া করে ফেরা আত্মহত্যা, মানুষের রক্তের ভেতর খেলা করা ‘বিপন্ন বিস্ময়’ এবং লাশকাটা ঘর। সেই শব্দগুচ্ছ, জানালা গলে আসা নিস্তব্ধতার চিত্রকল্প, সেই নিস্তব্ধতা উটের গ্রীবায় পরিণত হয়ে ঘাড় বাঁকা করে মাথা বাড়িয়ে দেয় জানালার ভেতর দিয়ে_ কী এক চিত্রকল্প! তবে সেটা ছিল আরম্ভ মাত্র। কে এই লোক, কে লিখেছে কবিতার এসব পঙ্ক্তি, এঁকেছে এসব মানসিক চিত্রাবলি? জ্যোতি আমাকে তার সম্পর্কে কিছু কিছু বলেছিলেন, তবে এও বলেছিলেন যে আমার বাংলা পর্বের প্রথম দু’বছর কাটানো শহর বরিশালের এই নির্জনতাকামী, মুখচোরা, লাজুক কবিটি সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। তখনও মনে হতো এবং এখনও মনে হয়, তাকে এবং তার কবিতা সম্পর্কে জানার প্রয়াসমূল্য আছে।’
১৪ অক্টোবর ১৯৫৪। কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুঘটনায় জীবনানন্দ আহত হন। পরে তার অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। অনেকেই ধারণা করেছেন আত্মহত্যাস্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল কারণ। জীবনানন্দ গবেষকরা মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তাঁর জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ। পরিশেষে বলতে চাই, কবির মৃত্যু আজও এক রহস্য। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে দুর্ঘটনার সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রামলাইন পার হচ্ছিলেন কবি। আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো মানুষ দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায় উঠবেন, সেটা কোনো যুক্তিবাদী মানুষের কাছে নিশ্চয়ই আত্মহত্যার জন্য যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু আত্মহত্যা নয়।
তথ্যসূত্র :
১) সত্যপ্রসন্ন দত্ত ও পরমানন্দ সরস্বতী সাধুর (মৃণালকান্তি দাশ) সাক্ষাৎকার।
২) বিষ্ণু দে’র সাক্ষাৎকার।
৩) অনন্য জীবনানন্দ (A Poet Apart) Clinton. B. Silli
৪) অশোকানন্দ দাশ, ‘বাল্যস্মৃতি’, পৃষ্ঠা- ১৩৪।
৫) সন্দীপ দত্ত সম্পাদিত : জীবনানন্দ প্রাসঙ্গিকী (কলকাতা: হার্দ্য,১৯৮৪), পৃষ্ঠা-১৫৮-১৫৯
৬) শনিবারের চিঠি, মাঘ ১৩৩৪,পৃষ্ঠা- ৬৬৯-৭২
৭) ক্যাম্পে: জীবনানন্দের সেই বিতর্কিত কবিতা (শুদ্ধতম কবি), পৃষ্ঠা-৩৭২
৮) জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রারম্ভিক সমালোচনা, মোহিত উল আলম। কালধারা দশম সংখ্যা, পৃষ্ঠা-১৯৪
৯) বুদ্ধদেব বসু, ‘চরম চিকিৎসা’, দেশ, ২৮ বৈশাখ,১৩৭৫, পৃষ্ঠা- ২৩৭
১০) কবিতা, পৌষ ১৩৬১ সংখ্যা।
১১) বুদ্ধদেব বসু ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সাক্ষাৎকার।
১২) দেশ, ২৯ আষাঢ়, ১৩৭৫, পৃষ্ঠা- ১২২৪।
১৩) প্রবেশক, শুদ্ধতম কবি; আব্দুল মান্নান সৈয়দ পৃষ্ঠা- ১১।
দারুন সয়ার
ReplyDelete