Skip to main content

ছেদচিহ্নের ব্যবহার জেনে নিন

 ছেদচিহ্নের সঠিক ব্যবহার কীভাবে করবেন:

ইউসুফ মোল্লা


   প্রথমেই বলে রাখি ছেদচিহ্ন আর যতিচিহ্ন এক জিনিস নয়। এই ভুলটা প্রায় সকল শিক্ষার্থী করে থাকে। 

     এবার বলি ছেদচিহ্নের সঠিক ব্যবহার কেন দরকার। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে:

একটি দোকানের পাশে পরিত্যক্ত জায়গা পেয়ে সবাই প্রস্রাব করতে থাকে, ফলে দোকানদার প্রস্রাবের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দোকানদার সেই জায়গার দেওয়ালে লিখে দিলেন, "এখানে প্রস্রাব করিবেন না, করিলে ৫০০ টাকা জরিমানা হইবে।" কিন্তু ভুল করে কমাটা 'না' শব্দের আগে হয়ে যায়। ফলে সবাই পড়তে থাকে, "এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে ৫০০ টাকা জরিমানা হইবে।" আসলে বাক্য, শব্দ সবকিছু ঠিক থাকলেও ছেদচিহ্নের  ভুল ব্যবহারের ফলে অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। তাই ছেদচিহ্নের সঠিক ব্যবহার জানা একান্ত প্রয়োজন। নিম্নে তাই ছেদচিহ্নের সঠিক ব্যবহার বোঝানোর চেষ্টা করলাম:-


১) পূর্ণচ্ছেদ (।) :

   প্রাচীন কাব্যে লক্ষ করা যায়, পংক্তি শেষ হলেই পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করা হয়। বাক্য শেষ হোক বা না হোক তার উপর নির্ভর করতো না। 

কিন্তু এখন ছেদচিহ্নের সঠিক ব্যবহার করতে সবাই সচেষ্ট। তাই বাক্য যেখানেই শেষ হবে, সেখানেই পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করা হয়। তা সে পংক্তির প্রথম দিকে হোক, মাঝে হোক বা শেষে হোক।


যেমন: "দাতা গ্রহীতা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। "


২) অর্ধচ্ছেদ (;) :

   পূর্ণচ্ছেদের থেকে একটু কম সময় থামলে, সেখানে অর্ধচ্ছেদ বসে। এটা সাধারণত হয়ে থাকে একটি বড়ো বাক্যের মধ্যে অনেক ছোট ছোট বাক্য থাকলে সেখানে অর্ধচ্ছেদ বসে। 


যেমন: "মেলা যেন কবিতা; বাজার গদ্য।"


৩) পাদচিহ্ন (,) :

   যেটাকে আমরা কমা হিসাবেই চিনি, এই পাদচিহ্ন হলো সেটি। কমার বাংলা হলো পাদচিহ্ন। অর্ধচ্ছেদের চেয়েও যেখানে কম থামতে হবে, সেখানে এটি বসবে। সাধারণত কারো ডাকলে, সাল, তারিখ, ঠিকানা, উপাধি অথবা দুই বা ততোধিক পদ পর পর বসলে এটি ব্যবহার করা হয়। 


যেমন: রাম, শ্যাম, যদু সবাই এসেছে। 

ওহে, কোথায় যাস? 


এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, অনেক জায়গায় এই পাদচিহ্ন সরাসরি উপস্থিত থাকে না। সেইসব অদৃশ্য স্থানে সচেতন পাঠক অতি অল্প সময়ের জন্য থামে। এটা বারবার পড়তে পড়তে আয়ত্তে চলে আসবে। 

যেমন: মৃত্যুঞ্জয় (,) বারবার করিয়া (,) এই স্বর্ণপুঞ্জ স্পর্শ করিয়া (,) ঘরময় ঘুরিয়া ঘুরিয়া (,) বেড়াইতে লাগিল। (গুপ্তধন:রবীন্দ্রনাথ) 


৪) জিজ্ঞাসা-চিহ্ন (?) :

     এই জিজ্ঞাসা চিহ্নের জায়গায় পূর্ণচ্ছেদের মতো সম্পূর্ণ থামতে হবে। যেখানে কোনরূপ প্রশ্ন করা হবে, সেখানে এই জিজ্ঞাসা চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। 


যেমন: স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? 


৫) বিস্ময়বোধক চিহ্ন (!) :

    এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, পূর্ণচ্ছেদ, জিজ্ঞাসা চিহ্ন এবং বিস্ময়বোধক চিহ্ন বাক্যের মধ্যে শ্রেণী নির্দেশ করে থাকে। 


      কারো সম্বোধন করলে অথবা ঘৃণা, ভয়, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, বিস্ময় প্রভৃতি বোঝালে এই চিহ্ন বসে। 


যেমন: "আহা কী দেখিলাম!"

"নমি তোমা, নরদেব!"


৬) উদ্ধরণ চিহ্ন (".... " অথবা '..... ') :

      আমরা যেটাকে উদ্ধৃত চিহ্ন হিসাবে চিনি, সেটিই ভালো ভাষায় উদ্ধরণ চিহ্ন বলা হয়। 

     অন্য কারো উক্তি উদ্ধৃত করলে এই চিহ্নের মধ্যে রাখা হয়। আর একটা জিনিস সবাই খেয়াল রাখবেন, উদ্ধরণ চিহ্নের আগে পাদচ্ছেদ চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে। 


যেমন: নেতাজী বলিয়াছেন, "তু মুঝে খুন দে, মৈ তুঝকো আজাদি দুঙ্গা। "


   আর একটা বিষয় খেয়াল রাখা খুব জরুরি, উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে অন্য আর একজনের উক্তি থাকলে '.... ' এই উদ্ধরণ চিহ্নের মধ্যে রাখতে হবে। 


যেমন: যুধিষ্ঠির বললেন, "দুঃখপীড়িত এই সংসারে মানুষ নিজের কামনার জালে নিজেই মাকড়সার মতো জড়িয়ে আছে। স্বয়ং ব্রহ্মা বলেছেন, 'শুধু পাপ ও অধর্ম থেকেই নয়, ধর্ম এবং পুণ্যেরও ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। ভালো এবং মন্দ উভয়ের দোষ থেকে মুক্ত হলে, মাটি আর সোনা এক হয়ে যায়।' "


৭) পদসংযোজক চিহ্ন (-) :

      যখন অনেকগুলো পদের বিশেষণপদ থাকে, তখন এই চিহ্ন দিয়ে একটাই পদে পরিণত করা যায়। 


যেমন: "সদ্য-গজিয়ে-ওঠা কচি কচি পাতা। "


     সমাসবদ্ধ পদ অথবা দুই বা ততোধিক পদ সন্ধিবদ্ধ না করার জন্য এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। এর ফলে শ্রুতিমাধুর্যতা ঠিক থাকে অনেকসময়। 


      কোন লাইন লিখতে গিয়ে যদি  একটা শব্দের কিছুটা অংশ লেখার পরে লাইনটাতে জায়গা না থাকে, তখন সেই শব্দের বাকি অংশ পরের লাইনে লিখতে হলে প্রথম লাইনের সেই অংশে পদসংযোজক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। 


৮) দৃষ্টান্ত চিহ্ন (:) :

   এটাকে কোলন চিহ্ন বলা হয়। 

কোন উদাহরণ দেওয়ার সময় এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। 


যেমন: পুরুষার্থ চারিটি : ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। 


৯) রেখা চিহ্ন ( ____) :

       একটা বিষয় বলতে বলতে অন্য বিষয় আরম্ভ করার আগে রেখা চিহ্নের ব্যবহার করা হয়। 


যেমন: "সকলেই লিখিবে ____ যে বাঙালী, সেই লিখিবে।"


     কোনো বিষয়ে দৃষ্টান্ত দেবার আগে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। 


    আগের কথাটি স্পষ্ট করতে অন্য কোন বাক্যাংশ প্রয়োগ করতে হলে এই রেখা চিহ্নের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 


      অনেক সময় রেখা চিহ্নের আগে কোলনও অনেকেই বসায়। অথবা কেবল কোলন বসায়, রেখা চিহ্ন বসায় না। সবগুলোই চলবে, ভুল নয় কোনটা। 


১০) লোপ চিহ্ন ( ' ) :

       পদের মধ্যে কোন বর্ণের লোপ ঘটলে, সেই লুপ্ত বর্ণের জায়গায় যে ঊর্ধ্ব কমার প্রয়োগ ঘটে, তাকে লোপ চিহ্ন বলে। 


যেমন: "আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-'পরে।" (ছন্দপতন ঘটবে বলে রবীন্দ্রনাথ পদটির 'উ' স্বরবর্ণটিকে লোপ করে দুই মাত্রা করেছেন) 


১১) বর্জন চিহ্ন (....) :

      কোন উদ্ধৃতি দেওয়ার সময় অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ করতে হলে, সেই জায়গায় এই বর্জন চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। 


যেমন: "ছুঁৎমার্গের বিরুদ্ধতা এর মধ্যে আপনিই এসে পড়েছে,..... তার দ্বারা মানুষের অপমান দূর হবে বলে, সেই অপমানে আমাদের প্রত্যেকের আত্মাবমাননা।"____ রবীন্দ্রনাথ। 


১২) বন্ধনী চিহ্ন ( ) [ ] :

        নাটকের অভিনয়ে মঞ্চনির্দেশের বিষয়গুলি বন্ধনী চিহ্নের অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। 


যেমন: নুরজাহান। [উচ্চৈঃস্বরে] লয়লা! 


     কোনো উদ্ধৃতির উৎস নির্দেশ করার সময় এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। 


যেমন: আমি তোমাকে সমস্ত পাপ ও অশুভ থেকে মুক্তি দেব। দুঃখ করো না। [শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৮/৬৬]


       বাক্যের মধ্যে কোনো পদ বা পদ সমষ্টির ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। 


যেমন: "দিবসের পঞ্চম অথবা ষষ্ঠভাগে (সন্ধ্যায়) নিজগৃহে যে শাকান্ন আহার করে, যে অঋণী অপ্রবাসী, সেই সুখী।" 


গ্রন্থ ঋণ:

উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ - বামনদেব চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পূর্ণ তথ্য

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় 🍄 তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়🍄 ✒কলমেঃ ইউসুফ মোল্লা 🍁 জন্ম: ২৫ জুলাই, ১৮৯৮ (৮ শ্রাবণ, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ) 🍁 জন্মস্থান: পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে। এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। যদিও সেটা ক্ষয়িষ্ণু ছিল। পরে ১৯৪০ সালে তিনি ও তাঁর পরিবার নিয়ে কলকাতার বাগবাজারে চলে আসেন এবং ১৯৪১ সালে চলে যান বরানগরে। 🍁 পিতা: হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। (বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ হলে তিনি মা ও বিধবা পিসির কাছে পালিত হয়)। 🍁 মাতা: প্রভাবতী দেবী 🍁পত্নী: উমাশশী দেবী (১৯১৬ সালে বিবাহ হয়) 🍁পিসিমা: শৈলজা দেবী(ধাত্রীদেবতা উপন্যাসে অমর হয়ে আছেন) 🍁মৃত্যু: ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ 🍁নামকরণের তাৎপর্য: লেখকের জন্মের আগেই তাঁর বড়োভাই মৃত্যুবরণ করেন। তাই, 'তারা' মায়ের পূজো করেন। সেই পূজোর ঠিক দশমাস পরেই জন্ম নিয়েছিলেন বলে মায়ের প্রতি সন্মান রেখে নামকরণ করা হয় তারাশঙ্কর। 🍁তারাশঙ্কর বিভ্রান্তি: 'শ্রীময়ী' উপন্যাসের জনকও শ্রীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ইনি আমাদের আলোচিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নন। তাই একই নামেই দুজন তারাশঙ্করের আবির্ভ

বনফুলের সম্পূর্ণ তথ্য

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)  - ইউসুফ মোল্লা( কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)  #জন্ম: ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই। #জন্মস্থান: বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বনফুলের পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার শিয়ালখালায়। #পিতা: সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। তিনি পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। #মাতা: মৃণালিনী দেবী। #ছোট ভাই: অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় #ভ্রাতুষ্পুত্র: অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় #স্ত্রী: লীলাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়(মুখোপাধ্যায়) #সন্তান: #বড়োমেয়ে: কেয়া মুখোপাধ্যায় #বড় ছেলে: অসীম মুখোপাধ্যায় #ছোটছেলে: রঞ্জন মুখোপাধ্যায় #ছোটমেয়ে: করবী মুখোপাধ্যায় (স্বামী: কাজলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের) #মৃত্যু: ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফ্রেব্রুয়ারি কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। #ছদ্মনাম: বনফুল #সম্পাদনা:   ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'বিকাশ' নামে হাতে-লেখা একটি সাহিত্য পত্রিকা। #শিক্ষাজীবন:       তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় প্রথমে মণিহারী স্কুলে। পরে সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯১৮ খ্রিষ

নবম শ্রেণীর উৎস সন্ধানে

∆সকল গল্প,কবিতা,নাটক,প্রবন্ধের উৎস নির্দেশ∆ #নবম_শ্রেণীর_সাহিত্যসঞ্চয়ন_সাহিত্যসম্ভার_ও_প্রফেসর_শঙ্কুর_ডায়রি **সাহিত্য সঞ্চয়ন নবম শ্রেণী** ১."কলিঙ্গদেশে ঝড়-বৃষ্টি" কবি - মুকুন্দরাম চক্রবর্তী । উৎস : চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খন্ড তথা কালকেতুর উপাখ্যান অন্তর্ভুক্ত "কলিঙ্গ দেশে ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ"। ২."ধীবর বৃত্তান্ত" লেখক - কালিদাস । উৎস :অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটকের ষষ্ঠ অঙ্ক ।  তর্জমা : সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী । ৩."ইলিয়াস" লেখক : লিও টলস্টয় উৎস : Twenty Three Tales (১৮৮৫) তর্জমা :মণীন্দ্র দত্ত । ৪."সাত ভাই চম্পা" কবি : বিষ্ণু দে । উৎস : সাত ভাই চম্পা । ৫."দাম" লেখক : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় উৎস : ১৩৬৫ বঙ্গাব্দে শারদীয়া "তরুণের স্বপ্ন" তে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । ৬."এই জীবন" কবি : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । উৎস : "দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায়" । ৭."নব নব সৃষ্টি" লেখক : সৈয়দ মুজতবা আলী । উৎস : এটি "মাম্ দোর পুনর্জন্ম" প্রবন্ধের সম্পাদিত অংশ । মূল